মা শৈলপুত্রীর কৃপাযাত্রায় এবার জুড়ল রামপুরহাটের নাম
" শৈলপুত্রী মহামায়ে সর্বসৌভাগ্যদায়িনী। " " সর্বক্লেশ হরে দেবী সর্ববিঘ্নবিনাশিনী।। " " নমস্তে বরদে শুভে সর্বঐশ্বর্য্যমন্ডিতা। " " প্রণমামি জগন্মাতঃ সর্বাভরণভূষিতা। "
1/1/20181 min read


(অঘোর তন্ত্রের একটি বিনম্র প্রতিবেদন)
কখন যে কার উপর মায়ের কৃপা হয় সেকথা জানা সহজ নয়। আচার্য্য রণব্রত হয়ত আগে থেকে কিছুটা পূর্বাভাস পেয়ে যান। তবে ঐ পর্যন্ত! দেশের মধ্যে উত্তরাখন্ড ও হিমাচলপ্রদেশ থেকে বার বার আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে কিন্তু মায়ের ইচ্ছা না হলে অপেক্ষা ছাড়া আর কিইবা করার থাকে! এমনকি রাশিয়া, জার্মানি ও সিঙ্গাপুর থেকে একাধিক আমন্ত্রণ এলেও সেখানে যাওয়া সম্ভব হচ্ছেনা। কারন একটাই - মায়ের অনুমোদন মেলেনি! এ নিয়ে আচার্য্যদেবকে অনেক অভিযোগ, অনুযোগ শুনতে হয় রোজ।
এরই মধ্যে স্বপ্নাদেশ হল রামপুরহাটে এক প্রশাসনিক কর্তার বাড়ীতে গিয়ে পূজা নেবার। যজমান ভদ্রলোক অনেকদিন ধরে অপেক্ষা করছিলেন। আদেশ মেলায় তাঁর আনন্দের সীমা ছিলনা। প্রবল উৎসাহে নিজের সেভেন সিটার বোলেরো পাঠিয়ে দিলেন কলকাতায়। ৩রা আগষ্ট বিকেলবেলা মা শৈলপুত্রীকে সঙ্গে নিয়ে আমরা সদলবলে রামপুরহাটের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।


কলকাতার আকাশ মেঘলা। পরেরদিন থেকে ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল। বোলেলোর ড্রাইভার বয়সে তরুণ হলেও সে সবাইকে খুব যত্ন করে গাড়ীতে বসাল। বোধহয় তার মনিবের তেমনই নির্দেশ ছিল। ই এম বাইপাস পেরিয়ে উল্টাডাঙ্গা ফ্লাইওভার ধরে খুব তাড়াতাড়ি পৌছে গেলাম বাগুইহাটি মোড়ে। সেখানে মায়ের একনিষ্ঠ ভক্ত রুদ্রদা অপেক্ষা করছিলেন। বেশ।লম্বা চওড়া চেহারার হাসিখুশি মানুষ। তাঁকে গাড়ীর সামনের আসনে বসানো হল। রাস্তাটা তিনি ভালই চেনেন - প্রয়োজনে ড্রাইভারকে গাইড করতে পারবেন। বিশেষ কারনে শিবানন্দ এ সফরে আমাদের সঙ্গে ছিলনা। শিবানন্দের শ্বশুরমশাই বগলাসিদ্ধ বিশ্বনাথবাবু তার পরিবর্তে আমাদের সঙ্গী হবেন। তাঁকে গাড়ীতে তোলা হবে দমদম সিঁথির মোড় থেকে। আমরা সময়ের আগেই সিঁথিমোড়ে পৌছে তাঁর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিন্তু তাঁর দেখা নেই। শেষ পর্যন্ত তিনি এলেন নির্দ্ধারিত সময়ের প্রায় আধাঘণ্টা পেরিয়ে। এতক্ষণ গাড়ীতে স্থিরহয়ে বসে থাকা অসম্ভব। অগত্যা কাছেই একটা দোকানে গিয়ে চায়ের অর্ডার দেওয়া হল। সবাই দেখলাম তুরীয় মেজাজে রয়েছেন। চায়ের সাথে আচার্য্যদেব খেলেন শুকনো মুড়ি আর আমরা খেলাম ছাতুভরা বেকারী বিস্কুট। পেট ভরল তবে মন ভরলনা। চায়ের সাথে ছাতুভরা বিস্কুটের কম্বিনেশন একেবারেই জমলনা। আমাদের সবার মুখ ব্যাজার। তবে আচার্য্যদেব দেখলাম বিজয়ীর হাসি হাসছেন। ভাবখানা এমন যেন বিস্কুটের বদলে মুড়ি খেয়ে তিনি জিতে গেছেন!
যাইহোক বিশ্বনাথবাবু একটুপরে এসে গাড়ীতে উঠলেন। তাঁকে বসানো হল গাড়ির পিছনের আসনে। জানাগেল তিনি পেটের গন্ডগোলে আক্রান্ত। গাড়ীতে উঠেই গাড়ীর সিটে ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দিলেন। গাড়ী চলল দক্ষিনেশ্বর ব্রিজ ধরে সোজা ডানকুনি। হাইওয়েতে গাড়ী চলতে লাগল ঝড়ের গতিতে ! একের পর এক গাড়ীকে ওভারটেক করতে করতে আমাদের বোলেরো এগিয়ে চলল। ইতিমধ্যে পশলা পশলা বৃষ্টি শুরু হয়েছে। গাড়ী যখন শক্তিগড়ের ল্যাংচা হাবে গিয়ে ল্যান্ড করল ঘড়িতে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। তবে লাংচা হাবে গিয়ে বাবলুভাই আর আমি ছাড়া ল্যাংচা খেলেননা কেউ। খেলেন সিঙ্গাড়া সহযোগে লিকার চা। আমি বরাবরই মিষ্টির ভক্ত। তাই সবাইকে মাখাসন্দেশ খাবার জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগলাম - এমন উৎকৃষ্ট সন্দেশ আর পাবেনা কোথাও! অনুরোধে ঢেঁকিগেলার মত করে সবাই রাজী হলেন। তবে সন্দেশ কেউ খেতে পারলেননা। গন্ধশুঁকেই সন্দেশ বাতিল করতে হল। সকালের সন্দেশ বিকেলে বাসি, হায় কপাল সর্বনাশী!
কয়েক বোতল ঠান্ডাজল নেওয়া হল সঙ্গে। এবার গাড়ী চলবে একটানা। গাড়ী চলল বিদ্যূৎগতিতে। বৃষ্টিবিরতি চলছে বটে তবে আকাশের মুখভার। যেকোনো সময় প্রবল বর্ষণ শুরুহতে পারে। গাড়ী বর্দ্ধমান, গুসকরা পেরিয়ে যখন ইলমবাজার এসে পৌছাল ভারীবৃষ্টি শুরু হল। বাধ্যহয়ে গাড়ীর গতি মন্থর। উইন্ডস্ক্রীন পরিস্কার রাখতে ওয়াইপার চলছে অনবরত। এরমধ্যে আচার্য্যদেবের শরীর প্রবলভাবে কাঁপতে লাগত। চোখের দিকে তাকানো যাচ্ছেনা তাঁর। গাড়ী থামাতে চাইলে ইশারায় আমাদের নিবৃত্ত করলেন তিনি । মিনিট পনের পর আবার তিনি স্বাভাবিক। বললেন আমাদের গন্তব্যস্থান থেকে অশরীরী কেউ এসেছিল তাঁর যাত্রা ভেস্তে দিতে! যদিও সফল হয়নি সে।
আমাদের জন্য যজমান ভদ্রলোক বোলপুরে অপেক্ষা করছিলেন। ছুটি পাননি। বাড়ীতে পূজার দায়িত্ব ছেড়েদিয়েছিলেন স্ত্রীর হাতে। তবে সৌজন্যবশতঃ বোলপুরে আমাদের সাথে একবার সাক্ষাৎ করে গেলেন। গাড়ী এগিয়ে চলল প্রান্তিক, খোয়াই পেরিয়ে মল্লারপুরের দিকে। সামনে ময়ূরাক্ষী নদীর উপর মোরাম বিছানো বাঁধ চোখে পড়ল। তার উপর দিয়ে সারিবদ্ধভাবে গাড়িগুলি পার হচ্ছে ধীরগতিতে! এখানে একফোঁটাও বৃষ্টি নেই। আকাশ পরিস্কার। কে বলবে পিছনে ইলমবাজার ভেসে যাচ্ছে প্রবল বর্ষণে! রামপুরহাটে যজমানের বাড়ীতে যখন পৌছানো গেল রাত তখন প্রায় সাড়ে দশটা। তাড়াতাড়ি করতে হবে। সময় খুবই কম। তবে সবকিছু গুছিয়ে পূজোয় বসতে বসতে রাত প্রায় ১টা দশ। বিশ্বনাথবাবু সারারাস্তায় খাননি কিছু। শরীর সুস্থ না থাকলে পূজা করবে কে? মা শৈলপুত্রীর পূজায় বসলেন বিশ্বনাথবাবু। আর তার ঠিক পাশের আসনে বসে চন্ডীপাঠ শুরু করলাম আমি। যজমান ভদ্রলোকের বাড়ী মুসলমান অধ্যুষিত এমন এক অঞ্চলে যে সেখানে গভীর রাতে মুক্তকন্ঠে পূজাপাঠের কিঞ্চিত অসুবিধা ছিল। তারই মধ্যে শত্রুদের হুমকি ফোন এসেছিল যজমানের স্ত্রীর মোবাইল ফোনে - যেকোনো সময় বন্দুকবাজেরা এসে সেখানে হামলা করতে পারে, গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিতে পারে বাড়ীর সবাইকে। আচার্য্যদেব অভয় দিয়ে সবাইকে বললেন - ঘরে মা এসেছেগো! আর ভয় কিসের? কার এমন বুকেরপাটা এ বাড়ীর চৌকাঠ পেরবে? সত্যি কিছু হলনা। নির্বিঘ্নে শেষ হল মায়ের পূজা, পাঠ ও হবন। ভোররাতে সাদাভাত, আলুরদম, পাঁচরকম ভাজা দিয়ে মায়ের প্রসাদগ্রহন করলাম আমরা সবাই। মনে হচ্ছিল ভাত নয় সবাই অমৃত ভক্ষণ করছি। তবে সাবধানী বিশ্বনাথবাবু একগ্রাস ভাতও মুখে তুললেননা। দুটি সন্দেশ দিয়ে সামান্য জলযোগ সারলেন। বারবার বলা সত্বেও তিনি একপ্রকার উপবাসেই রয়ে গেলেন। ফলে আরো দুর্বল হয়েপড়লেন তিনি। তাঁর উপবাস ভাঙল ফিরতি পথে ডানকুনির এক ঢাবায় - আলুর পরোটা, কালিডাল আর বিশুদ্ধ গাভীদুগ্ধের দহি সহযোগে। এর সবটুকু ক্রেডিট প্রাপ্য আচার্য্যদেব ও রুদ্রদার । সবাইকে ব্রেকফাস্ট করাবেন বলে ডানকুনির কাছে গাড়ী থেকে নেমে হাইওয়ের ঠিক পাশে বট-অশ্বত্থের ছায়াঘেরা প্রায় আশ্রমসদৃশ এক বিরল ঢাবা খুঁজে বের করেছিলেন তাঁরা। ঢাবার পাশেই একটি অত্যন্ত সৌম্যদর্শন সবৎসা গাভী চোখে পড়ল। আচার্য্যদেব পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলেন গাভীটির দিকে। গলায় হাত দিয়ে একটু আদর করলেন। গাভীটিও আরামে চোখবুজে কিছুক্ষণ আচার্যদেবের আদর খেয়েনিল। গাভীটির দুধ যে ঠিক কতটা উৎকৃষ্ট তার প্রমান পাওয়া গেল দহি সহযোগে আলুর পরোটা খেতে গিয়ে। সত্যি স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয় এমন দই আমরা শেষ কবে খেয়েছি মনেকরা গেলনা। আচার্য্যদেব বললেন - সবই মায়ের কৃপা! নইলে পথের পাশে এমন খাবার মেলেনা গো! মা শৈলপুত্রীর নামে জয়ধ্বনি আমরা সবাই গাড়ীতে চেপে বসলাম। ডানকুনি থেকে কলকাতা দুরত্ব বেশী নয়। আর কিছুক্ষণের মধ্যে বাড়ী পৌছে যাব সবাই!
" জয় মা শৈলপুত্রীর জয়! "